ব্রহ্মপুত্র নদের জানা অজানা তথ্য

ব্রহ্মপুত্র নদ (Brahmaputra River) হলো পৃথিবীর দীর্ঘতম নদনদীগুলির একটি। এর অববাহিকা অঞ্চল চীনের তিব্বত, ভারত ও বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। এর উৎপত্তি শিমায়াঙ-দাঙ হিমবাহ থেকে, স্থানটি (৩১°৩০´ উত্তর এবং ৮২°০´ পূর্ব) পারখা থেকে প্রায় ১৪৫ কিলোমিটারের মতো দূরে। পারখা, মানস সরোবর হ্রদ ও কৈলাস পর্বতের মধ্যবর্তী গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র। দক্ষিণ তিববতের শুষ্ক ও সমতল অঞ্চলের দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে নদটি হিমালয়ের ‘নামছা বারওয়া’ চূড়ার সন্নিকটে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এর উচ্চতা ৭,৭৫৫ মিটার। ভারতের ভূখন্ডে এর প্রধান উপনদীগুলি হলো আমোচু, রেইডাক, সঙ্কোশ, মানস, ভারেলি, দিবাঙ এবং লুহিত। তিব্বত ভূখন্ডের একাধিক উপনদী আংশিকভাবে মূল হিমালয় এবং জাঙপোর মধ্যবর্তী অঞ্চল থেকে উদ্ভূত হয়েছে। দক্ষিণপশ্চিম তিব্বতের উৎপত্তি স্থল থেকে ব্রহ্মপুত্রের সর্বমোট দৈর্ঘ্য ২৮৫০ কিমি।

আসামের হিমালয় অঞ্চলে ব্রহ্মপুত্র দিহাঙ নামে পরিচিত। পূর্ববঙ্গের বিশাল বিস্তৃত সমভূমিতে প্রবেশের পূর্ব পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্র ঐ নামেই পরিচিত। উত্তরপূর্ব আসামের সাদাইয়া নামক স্থানের কাছে পূর্ব দিক থেকে দিবাঙ এবং লুহিত এর সাথে মিলেছে। দিবাঙ উপনদী দিহাঙের পূর্ব হিমালয়ের নিষ্কাশন প্রণালী এবং লুহিত আসাম ও মায়ানমারের মধ্যবর্তী অঞ্চলের নিষ্কাশন পরিচালনা করে।

তিব্বতের সমভূমির মধ্য দিয়ে ব্রহ্মপুত্রের গতিপথটি জাঙপো হিসেবে পরিচিত এবং লাসার দক্ষিণে এর গতি মন্থর। উৎসমুখ থেকে নামছা বারওয়া-র কাছে কেন্দ্রীয় হিমালয় অঞ্চলে প্রবেশ মুখ পর্যন্ত তিব্বত ভূখন্ডে নদটির অতিক্রান্ত দৈর্ঘ্য ১৬০০ কিমি। তিববতে নদটির সঙ্গে তিনটি উপনদী যুক্ত হয়েছে। এর তলদেশ ভূমির উচ্চতা ত্রাদমে ৪,৫২৩ মিটার, নামছা বারওয়ার কাছে গেইলা সিনডং-এ ২,৪৪০ মিটার, এবং উত্তরপুর্ব আসামের সাদাইয়াতে মাত্র ১৩৫ মিটার। বাংলাদেশে প্রবেশের পূর্বে আসামে এটি বন্ধুর দক্ষিণপশ্চিম দিক থেকে শিলং অধিত্যকার উত্তর পর্যন্ত প্রবাহিত হয়েছে।

আসামের সমভূমিতে ব্রহ্মপুত্র একটি বিশাল নদ। নদটিতে রয়েছে অসংখ্য দ্বীপ এবং এটি প্রায়শই এর গতিপথ পরিবর্তন করে। আসাম উপত্যকায় অনুপ্রস্থভাবে ৭২০ কিমি দীর্ঘ গতিপথ অতিক্রমের পরে এটি গারো পাহাড় ঘিরে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এবং গঙ্গা ও দক্ষিণের সাগরে মেলার পূর্ব পর্যন্ত এর দক্ষিণমুখী প্রবাহের দৈর্ঘ্য ২৪০ কিমি-এর কাছাকাছি। বাংলাদেশে এর প্রবাহ অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত, যা পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নামে পরিচিত। প্রকৃতপক্ষে, ব্রহ্মপুত্র দক্ষিণ পূর্বাভিমুখে ময়মনসিংহ জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল। ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে তৈরি রেনেলের মানচিত্রে এভাবেই নদটির গতিপথ চিহ্নিত হয়েছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে এর তলদেশের উচ্চতা মধুপুর গড়ের ভূ-গাঠনিক আলোড়নের কারণে বৃদ্ধি পেয়েছিল। সমগ্র নিম্ন ব্রহ্মপুত্র নদ জালের মতো ছড়ানো নদীখাতসমূহের সমন্বয়ে গঠিত, শীত মৌসুমে যা শুষ্ক থাকে কিন্তু বর্ষা মৌসুমে প্লাবিত হয়। এর অসংখ্য দ্বীপ রয়েছে যা স্থানীয়ভাবে চর নামে পরিচিত। দেশের উত্তর-দক্ষিণ অভিমুখে প্রবাহিত এই নদীপ্রণালীটি সর্বাপেক্ষা প্রশস্ত। গোয়ালন্দঘাটে ব্রহ্মপুত্র গঙ্গার সঙ্গে মিলিত হয়েছে।

এই বিশাল নদটির প্রভাবিত এলাকার আয়তন ৫,৮৩,০০০ বর্গ কিমি, যার ৪৭,০০০ বর্গকিলোমিটারের অবস্থান বাংলাদেশ এলাকায়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নদীটি বিনুনি ধরনের। এর প্রধান চারটি উপনদীর নাম দুধকুমার, ধরলা, তিস্তা এবং করতোয়া-আত্রাই প্রণালী। প্রথম তিনটি নদী প্রবণতার দিক থেকে খরস্রোতা। ভারতের দার্জিলিং এবং ভুটানের মধ্যবর্তী হিমালয়ের দক্ষিণ পার্শ্বীয় খাড়া জলধারণ খাত থেকে এদের উৎপত্তি। ব্রহ্মপুত্রের সকল শাখার মধ্যে পুরাতন ব্রহ্মপুত্রই সর্ববৃহৎ, যা ছিল ২০০ বৎসর পূর্বে বর্তমান ব্রহ্মপুত্রের গতিপথ। ১৭৮৭ সালের তীব্র ভূমিকম্প ও প্রলয়ংকরী বন্যার পরে নদীটির গতিপথে পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছিল।

বর্ষা মৌসুমে ব্রহ্মপুত্র বিশাল আয়তনের পানি অপসারণ করে এবং একই সময়ে এটি প্রচুর পরিমাণ পলিও বহন করে। নদটির প্রশস্ততা স্থান ভেদে ৩ থেকে ১৮ কিমি পর্যন্ত, তবে গড় প্রশস্ততা ১০ কিমি-এর মতো। বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্রের নতিমাত্রা ০.০০০০৭৭ থেকে গঙ্গার সঙ্গে মিলন স্থলের কাছে হ্রাস পেয়ে ০.০০০০৫-তে দাঁড়িয়েছে। নদটি বছরে প্রায় ৭২৫ মিলিয়ন টন পলি বহন করে থাকে।

প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মপুত্র নদ বহু নদীখাত সম্বলিত একটি নদ। বাংলাদেশ ভূখন্ডে নদীখাতগুলি বহু ধরনের আকৃতিবিশিষ্ট। এসব নদীখাতের প্রশস্ততা কয়েক শত মিটার থেকে কয়েক কি.মি. পর্যন্ত বিস্তৃত। ধরনেও রয়েছে বিভিন্নতা- বিনুনি, সর্পিল। বাংলাদেশের অর্থনীতি ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্রহ্মপুত্র নদের গুরুত্ব অপরিসীম।

Similar Posts

2 Comments

  1. লেখাটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
    লেখাটি পড়ে ভালো লাগলে শেয়ার করতে ভুলবেন না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *