শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা

আমাদের প্রাণপ্রিয় ময়মনসিংহ শহরের একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা হচ্ছে ‘শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা‘। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন আমাদের বৃহত্তর ময়মনসিংহের‌ই সন্তান। তার জন্মভূমিতে গড়ে ওঠা এই সংগ্রহশালা বাংলার তৎকালীন ইতিহাস-ঐতিহ্যের এক উজ্জ্বল প্রতিফলন। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর কর্তৃক পরিচালিত এই সংগ্রহশালা ভ্রমণপিয়াসু অভিযাত্রীদের আকর্ষণ করে আসছে বরাবরই। তাই আজ এই সংগ্রহশালার ইতিহাস, অবস্থান, বর্ণনা সহ যাবতীয় প্রয়োজনীয় তথ্যাবলী প্রদান করে এই লেখনী সম্পন্ন করলাম। একজন ভ্রমণপিয়াসু এর থেকে বিন্দু পরিমানে উপকৃত হলেও আমার এ কাজ পরিপূর্ণতা পাবে। ধন্যবাদ।

ইতিহাস:

ময়মনসিংহের বুক চিরে বয়ে গেছে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ। এই নদীর তীরেই ইংরেজ আমলে একটি দোতলা ভবনে থাকতেন জনৈক ইংরেজ বার্ডেন সাহেব। তার কাছ থেকে বাড়িটি কিনে নেন জনৈক নলিনীরঞ্জন সরকার। তিনি ছিলেন তৎকালীন বড়লাট তথা কাউন্সিল সদস্য। পরবর্তীতে 1947 সালে এই বাড়িটির মালিকানা চলে যায় সরকারের হাতে যখন বড়লাট দেশবিভাগের কারণে ভারত চলে যান।

পরবর্তীতে 1971 সাল পর্যন্ত ভবনটি বিভিন্ন সরকারি কাজে ব্যবহৃত হতে থাকে। অবশেষে 1975 সালের 15 এপ্রিল তারিখে তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভবনটিকে ‘শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা’ হিসেবে শুভ উদ্বোধন করেন।

দেশব্যাপী শিল্পাচার্যের বিভিন্ন শিল্পকর্মগুলো সংগ্রহ করে এই সংগ্রহশালায় সংরক্ষণ করা হয়। শিল্পকর্মগুলো 2006 সালে নতুন করে পুনঃবিন্যাস করা হয়। এ সময় দোতলা ও নিচতলায় যথাক্রমে ছবির গ্যালারী ও ব্যবস্থাপনা কক্ষ‌ও আলাদা করা হয়।

বর্ণনা :
পূর্বমুখী মূল ফটকের ঠিক সামনেই রয়েছে পাথর নির্মিত জয়নুল আবেদিনের ভাস্কর্য সমৃদ্ধ ‘শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন স্মৃতি স্মারক’। সংগ্রহশালার উত্তরে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ, দক্ষিণে সরকারি কর্মকর্তাদের বাসভবন, সামনে অর্থাৎ পূর্বে জয়নুল আবেদিন পার্ক ও পশ্চিমে অর্থাৎ পেছনে রয়েছে আবাসিক এলাকা। সংগ্রহশালাটি চারিদিকে ইট লোহার দেয়াল দ্বারা বেষ্টিত এবং মূল ফটক লোহার তৈরি। মূল ভবনটির চারপাশে বিভিন্ন রঙিন ফুল ও পাতা বিশিষ্ট গাছের বাগান থাকায় একটি মনোরম নির্মল আবেশ বিরাজ করে।

ফটকে প্রবেশ করলেই দেখা যায় মূল ভবনটি যার সামনের বাগান বেষ্টিত মাঝারি আকারের একটি মাঠ। মাঠের দক্ষিণ পাশে রয়েছে ছোট্ট একটি মঞ্চ। মাঠটি বিভিন্ন শিল্পভিত্তিক কার্যক্রমেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। মূল ভবনের সামনেই ব্রোঞ্চ নির্মিত শিল্পাচার্যের আরেকটি ভাস্কর্য রয়েছে। মূল ভবনের নিচতলায় ব্যবস্থাপনা কক্ষের সাথে কিছু শিল্প প্রদর্শনী থাকলেও মূল প্রদর্শনী রয়েছে দুতলায়। মূল সংগ্রহশালা ভবনের পেছনে রয়েছে ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তাদের আবাসিক বাসভবন। তাছাড়াও রয়েছে পরিদর্শক শিল্পরসিকদের সাময়িক আবাসনের জন্য তিনটি আবাসিক কুটির।

বর্তমান তাৎপর্য:

বর্তমানে সংগ্রহশালাটি তে সংরক্ষিত শিল্পকর্মের সংখ্যা 63 টি। কিন্তু প্রতিষ্ঠাকালীন সময় মোট সংগ্রহ করা চিত্রকর্মের সংখ্যা ছিল 70 টি। 1982 সালে সংগ্রহশালা থেকে 17 টি বিখ্যাত চিত্রকর্ম চুরি হয়ে যায়। পরবর্তীতে দশটি চিত্রকর্ম পুনরুদ্ধার সম্ভব হলেও বাকি সাতটি আর খুঁজে পাওয়া যায় না। সংগ্রহশালাটি মূলত পাঁচটি অংশে বিভক্ত। সেগুলো হলো: নিচতলার বারান্দা; নীচতলার ব্যবস্থাপনা বিভাগ; দোতলার বারান্দা; দুতলার 1 নং ও 2 নং গ্যালারি।

নিচতলার বারান্দায় ও দোতলার বারান্দায় শোভা পাচ্ছে জয়নুল আবেদীন এর জীবদ্দশায় তার, তার পরিবার, উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিবর্গ বা উল্লেখযোগ্য ঘটনা সম্পৃক্ত স্থিরচিত্রসমূহ। এগুলো নিয়ে বিশেষভাবে উল্লেখ করার মত তেমন কিছু নেই। 1 নং গ্যালারিতে রয়েছে শিল্পাচার্যের সকল চিত্রকর্ম সমূহ। নিচে চিত্রকর্মগুলোর একটি তালিকা দেওয়া হল:

শিল্পাচার্যের চোখে শম্ভুগঞ্জ ঘাট, শিল্পাচার্যের চোখে শম্ভুগঞ্জ ব্রিজ, পরপর পাঁচটি স্কেচ, শিল্পাচার্যের চোখে বংশীবাদক এর স্কেচ, বাস্তুহারা, শিল্পাচার্যের হাতে আঁকা দুজন ব্যক্তির প্রতিকৃতি, আরেকটি স্কেচ, তৈলচিত্রে মহিষের বাচ্চা, তৈলচিত্রে কাজী নজরুল ইসলাম, কংকালসার, দুর্ভিক্ষের পরপর তিনটি চিত্রকর্ম যেগুলো বরাবরই বিখ্যাত, তৈলচিত্রে আঁকা রমনী-১, ১৯৫১, কাগজে টেম্পোরা, মা ও ছেলে- ১৯৫১, কাগজে টেম্পোরা, কলসী কাঁখে- ১৯৫১, কাগজে টেম্পোরা, স্নান শেষে- ১৯৫১, কাগজে টেম্পোরা;,মা ও শিশু- ১৯৫৩,,কাগজে টেম্পোরা, তিন রক্ষী- ১৯৫৩, কাগজে টেম্পোরা, চিন্তা- ১৯৫৩, কাগজে টেম্পোরা, চিন্তা- ১৯৫৩।

এছাড়াও রয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত তার 807 টি চিত্রকর্মের মাঝে থেকে বিখ্যাত গুলোর নকল কপি। যার সবগুলোই তার অসাধারণ প্রতিভার প্রতিফলন করে।

2 নং গ্যালারি টি মূলত শিল্পাচার্যের ব্যক্তিজীবন সম্পর্কিত স্মৃতি বহন করে। এই গ্যালারিতে রয়েছে শিল্পাচার্যের ব্যবহৃত জুতা, কোট, রং তুলি, চিত্রপট, কলম, শার্ট,, প্যান্ট, চৌকি, চশমা, ব্যবহৃত বিভিন্ন রং এর উচ্ছিষ্ট ও তার নিত্য প্রয়োজনীয় আরো কিছু সামগ্রী। তাছাড়া 2 নং গ্যালারিতে কিছু বিশেষ স্থিরচিত্র‌ও রয়েছে, যেগুলো কিছু বিশেষ ঐতিহাসিক তাৎপর্য বহন করে।

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন

ভ্রমণ ও পরিদর্শন:

ময়মনসিংহ শহরে অবস্থানকারী সবাই অন্তত একবার হলেও সার্কিট হাউজ পার্ক অর্থাৎ জয়নুল আবেদিন পার্কে ভ্রমণ করেছেন। যদি ভ্রমণ না করে থাকেন তবুও কোন সমস্যা নেই। শহরের যেকোন প্রান্ত থেকেই সার্কিট হাউজ পার্কের নাম বললে যেকোন রিক্সাওয়ালাই খুব সহজেই চিনতে পারবেন। সেক্ষেত্রে দূরত্ব ভেদে ভাড়ার পরিমাণ কমবেশি হবে। তবে বহিরাগতরা যারা রেলপথ বা স্থলপথে ময়মনসিংহে আসবেন তাদের জন্য একটি আনুমানিক রিকশাভাড়ার পরিমাপ দেওয়া হল।

* ময়মনসিংহ রেলওয়ে স্টেশন-জয়নুল আবেদিন পার্ক এর রিক্সাভাড়া আনুমানিক 30 টাকা থেকে 50 টাকা এর মাঝে।

* ময়মনসিংহ জিরো পয়েন্ট-জয়নুল আবেদিন পার্ক এর রিক্সাভাড়া আনুমানিক 10 টাকা থেকে 20 টাকার মাঝে।

* ময়মনসিংহ ব্রিজ-জয়নুল আবেদিন পার্ক এর রিক্সাভাড়া আনুমানিক 30 টাকা থেকে 50 টাকার মাঝে।

* ময়মনসিংহ বাইপাস মোড়- জয়নুল আবেদিন পার্ক এর রিকশাভাড়া 40 টাকা থেকে 60 টাকার মাঝে।

* ময়মনসিংহ টাউন হল মোড় থেকে জয়নুল আবেদিন পার্ক এর রিকশা ভাড়া 10 টাকা থেকে 15 টাকার মাঝে। তবে এক্ষেত্রে রিক্সা না নেওয়াই উত্তম। সার্কিট হাউজ মাঠের পাশ দিয়ে মনোরম পরিবেশে পরিচ্ছন্ন রাস্তায় হাঁটতে বেশ ভালোই লাগবে।

এবার আসা যাক পার্ক থেকে সংগ্রহশালায় যাওয়ার ব্যাপারটা। কঠিন কিছুই না, শুধু পার্কের মূল রাস্তা বরাবর পশ্চিম দিকে হাঁটতে থাকবেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই সামনে দেখতে পাবেন শিল্পাচার্যের ভাস্কর্য সমৃদ্ধ ‘শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন স্মৃতি স্মারক’।

আর এর ঠিক সামনেই দেখা যাবে, আপনার কাঙ্খিত ‘শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা’।

সময়সীমা ও টিকেট মূল্য:

জয়নুল আবেদিন সংগ্রহশালা সরকারি বন্ধ সমূহ ব্যতীত সপ্তাহের ছয়দিন খোলা থাকে। বৃহস্পতিবার সংগ্রহশালাটি বন্ধ থাকে গ্রীষ্মকালীন সময়ে (এপ্রিল-সেপ্টেম্বর):_ শুক্রবারে খোলা থাকে দুপুর ৩:০০-রাত ৭:৩০ সপ্তাহের অন্যান্য দিন খোলা থাকে সকাল ১১:৩০-বিকাল ৫:৩০ শীতকালীন সময়ে (অক্টোবর-মার্চ):_ শুক্রবারে খোলা থাকে দুপুর ২:৩০- রাত ৭:০০ সপ্তাহের অন্যান্য দিন খোলা থাকে সকাল ৯:৩০-বিকাল ৪:০০ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির অর্থাৎ 12 বছরের বেশি বয়সী ব্যক্তির প্রবেশ টিকিটের মূল্য 5 টাকা। 12 বছরের কম বয়সি শিশুদের জন্য প্রবেশ টিকিটের মূল্য ২ টাকা। বিদেশ থেকে আসা বহিরাগতদের ক্ষেত্রে একটু ব্যতিক্রম আছে। সার্কভুক্ত দেশগুলোর ক্ষেত্রে টিকেট মূল্য বাংলাদেশের অনুরূপ। সার্কভুক্ত দেশের বাইরের যে কেউ এলে তার জন্য টিকেট মূল্য জনপ্রতি 75 টাকা।

গুগল ম্যাপ এ সংগ্রহশালার অবস্থথান

Similar Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *